
ঘন ঘন ও অতিরিক্ত পাতলা পায়খানা হওয়াকে ডায়রিয়া বা উদরাময় বলে। খাদ্যবস্তু বেশিক্ষণ অন্ত্রে না থাকায় এগুলির পরিপাক ও বিশোষণ সম্পূর্ণ হয় না এবং খাদ্য উপাদানগুলি দ্রুত মলের সাথে বের হয়ে আসে। এতে করে পায়খানার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। প্রচুর অশোষিত পানি এর সাথে বের হতে থাকায় পায়খানা পাতলা হয়।
ডায়রিয়া সাধারণত দুই রকমের হয়ে থাকে।
১। অন্ত্রের কার্যঘটিতঃ এই রকম ডায়রিয়া তেমন মারাত্নক নয়। সাধারণ সুস্থ মানুষের অন্ত্রে কোনরকম উত্তেজনার সৃষ্টি হলে এই রকম হতে পারে। অতিরিক্ত খাওয়া হলে, পচা বা বাসি খাওয়া হলে, অন্ত্রের মাঝে খাদ্যের পচন হলে, শর্করা জাতীয় খাদ্যের অসম্পূর্ণ পরিপাকের ফলে গাজনের সৃষ্টি হলে ডায়রিয়া হতে পারে। এছাড়া মানসিক কারণ যেমন ভয়, উত্তেজনা, অস্থিরতা অথবা মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হবার দরুন ডায়রিয়া হতে পারে। এই ধরনের ডায়রিয়ার স্থায়িত্বকাল অল্প। ২\১ দিনের পরেই এটা সেরে যায়।
২। জীবাণু সংঘটিতঃ কোন কোন সময় ডায়রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হয়, সহজে সারতে চায় না অথবা একবার সারলেও আবার কয়েকদিন পর হয় এবং বার বার এরকম পাতলা পায়খানা হতে থাকে। এই ধরনের ডায়রিয়া রোগ জীবাণুর দরুন হয়ে থাকে। ই-কোলাই, রোটা ভাইরাস ইত্যাদি বিভিন্ন জীবাণু অন্ত্রে স্থান করে নিলে অথবা খাদ্য দ্বারা জীবাণু অন্ত্রে প্রবেশ করলে এই ধরনের ডায়রিয়া দেখা দেয়।
যে কারণেই ডায়রিয়া হোক না কেন বার বার পাতলা পায়খানা ও বমি হতে থাকলে দেহ থেকে প্রচুর পানি ও খনিজ লবণ বের হয়ে আসে এবং দেহে এগুলির ঘাটতি ঘটে। এর ফলে রোগীর মাথাধরা ও অস্থিরতা দেখা দেয়। ডায়রিয়া হলে খাদ্য উপাদানগুলো পরিপাক ও বিশোষণ ব্যাহত হয় এবং দেহে পুষ্টির অভাব ঘটে।
পথ্যাদিঃ কারণ যাই হোক না কেন ডায়রিয়া হলে এমন ভাবে পথ্য দিতে হবে যেন অন্ত্রের উত্তেজনা প্রশমিত হয়। আশবিহীন, সহজপাচ্য, নরম খাদ্য রোগীর অন্ত্রের উত্তেজনা নিবারণ করে। এই ধরনের খাদ্যকে কম আশযুক্ত বা কম তলানীযুক্তত খাদ্য বলে। এই ধরনের খাদ্যে চাহিদামত সকল পুষ্টিউপাদান এবং প্রচুর পানি থাকা দরকার।
তীব্র ডায়রিয়াঃ কোন কারণে হঠাত ডায়রিয়া আরম্ভ হলে তীব্র রূপ ধারণ করলে অর্থাৎ ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হতে থাকলে শরীর খুব দূর্বল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় খাবার একেবারে বন্ধ করে দেয়া উচিত নয়। তবে শক্ত খাবার অন্তত ২৪ ঘন্টার জন্য বন্ধ করতে হবে। শুধুমাত্র শরবত বা ডাব অল্প অল্প করে বারেবারে খাওয়ানো উচিত। কিন্তু দুধ এবং আশযুক্ত খাবার দেয়া ঠিক নয়। পানি, একটু লবণ এবং গ্লুকোজ ভা চিনি মিশিয়ে শরবত তৈরী করা যায়। এই শরবতকে মুখে খাওয়ার স্যালাইন বলা হয়। তীব্র ডায়রিয়া হলে এই স্যালাইন বারে বারে খাওয়ানো দরকার।

১৯৭৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে এই রকম স্যালাইন তৈরীর যে ফমূর্লা দেওয়া হয়েছিল তা উদ্ধৃত হলোঃ
সোডিয়াম ক্লোরাইড ( খাবার লবণ ) – ৩.৫ গ্রাম
সোডিয়াম বাই কার্বনেট ( বেকিং সোডা ) -২.৫ গ্রাম
পটাশিয়াম ক্লোরাইড – ১.৫ গ্রাম
গ্লুকোজ – ২০ গ্রাম
পানি – ১ লিটার
সাধারণ নিয়মে ঘরে বসেই স্যালাইন তৈরীর কথা এখন অনেকেই জানে। আধাসের পরিষ্কার পানিতে তিন আংগুলের এক চিমটি পরিমাণ লবণ এবং চার আংগুলের ১ মুঠি পরিমাণ গুড় বা চিনি দিলে এ ধরনের স্যালাইন তৈরী করা যায়।
শুধু তীব্র ডায়রিয়া নয়, কলেরার রোগীকেও এই স্যালাইন বারে বারে খাওয়াতে হয়। পাতলা পায়খানা ও বমি হতে থাকলে রোগী পিপাসার্ত হয় তখন এই সরবত তাকে খাওয়াতে থাকলে রোগী একটু সুস্থ বোধ করে। ডাবের পানি ও এসময় ঐ একই ভূমিকা পালন করে।
সাধারণত ২৪ থেকে ৮ ঘণ্টা পর ডায়রিয়ার তীব্রতা কমে আসে, তখন বার্লি, মুরগীর বাচ্চার স্বচ্ছ স্যুপ, ছাকা ফলের রস, চা ও কফি দেওয়া যেতে পারে। এরকম তরল পথ্যে অন্ত্রকে অভ্যস্ত করার পর নরম গালা ভাত, আধা সিদ্ধ ডিম,পুডিং ও পাউরুটির নরম অংশ খাওয়ানো যেতে পারে। এর সকল খাদ্যে আশ ও সেলূলোজ নেই এবং পরিপাক ও বিশোষোণের পরে অবশেষ এত কম থাকে যে এরা অন্ত্রে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে না। ডায়রিয়ার প্রাথমিক অবস্থা কেটে গেলে রোগীকে তার দেহের ক্ষয়পূরণের জন্য প্রচুর ক্যালরি ও প্রোটিন দিতে হবে। মাছ, মুরগির মাংস, কলিজা ইত্যাদি নরম ও আশবিহীন আমিষ খাদ্য এসময় দেওয়া ভালো। ভাজা খাদ্য, আস্তফল, দুধ, মোটা চালের ভাত, কেক, সিংগাড়া, চর্বিযুক্ত মাছ-মাংস, অতিরিক্ত মশলা ইত্যাদি পরিহার করে চলা উচিত। মাখন বা সর অল্প পরিমানে খেলে কোন ক্ষতি হয় না। তীব্র ডায়রিয়ায় প্রথম ১ দিন শুধু শরবত, তারপর কয়েকদিন তরল ও পরে আধাতরল অর্থাৎ নরম আশবিহীন পথ্য দেওয়া উচিত। রোগ নিরাময়ের পর ধীরে ধীরে পরিবারের জন্য প্রস্তুত অন্যান্য খাদ্য অল্প পরিমাণে খাওয়া অভ্যাস করতে হবে।
পুরনো ডায়রিয়াঃ অনেকদিন যাবত কেউ যদি ডায়রিয়ায় ভুগতে থাকেন তবে তার জন্য এমনভাবে পথ্য প্রস্তুত করতে হবে যেন তার দেহের ক্ষয়পূরণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত সকল উপাদান ঐ পথ্যে থাকে। প্রোটিনবহুল খাদ্য যেমন মাছ, নরম মাংস, ডিম ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে এসময় দরকার হয়। তীব্র বা পুরনো ডায়রিয়া যে রকম ডায়রিয়াই হোক না কেন পথ্যাদি সবসময় নরম ও আশবিহীন হতে হবে। তবে পুরনো ডায়রিয়ায় ক্যালরি ও প্রোটিনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিশেষ যত্নের সাথে প্রচুর ক্যালরি ও প্রোতীনবহুল খাদ্য দিতে হবে। সাথে ভিটামিন ট্যাবলেট বিশেষ করে বি-ভিটামিন দেওয়া প্রয়োজন।
এসকল পথ্যাদি প্রস্তুতের সময় মসৃণ ও সহজপাচ্য খাদ্যবস্তু, যাতে সেলুলোজ ও অন্যান্য অপাচ্য বস্তু প্রায় নাই- এমন খাদ্য নির্বাচন করতে হবে। প্রোটিন ও ক্যালরিবহুল আহার্য প্রস্তুত করতে ডিম, মাছ, পনির, ছানা, কচিমাংস, মধু, চিনি, আলু, ভাত ইত্যাদি উপযুক্ত খাদ্য। ফলের রস ছেঁকে খাওয়া উচিত। কিন্তু একমাত্র পাকা কলা ছাড়া অন্যান্য আস্ত ফল ও শাকসবজি পরিহার করে চলতে হবে।

একজন পুরনো ডায়রিয়া রোগীর জন্য অধিক প্রোটিন ও ক্যালরিবহুল খাদ্যের নমুনা দেওয়া হলোঃ
সকালেঃ
ডিম সিদ্ধ- ২ টা
সুজির পায়েস – হাফ কাপ
পাকা কলা – ১টা
পাউরুটির নরম অংশ – ১স্লাইস
জেলী – ২ চা চামচ
চা – ১কাপ
বেলা ১০ টায় – শরবত
দুপুরেঃ
নরম ভাত – ১ কাপ
শিংমাছ আলুর তরকারী – ১ পরিবেশন
শাকসবজির স্যুপ ( ছেঁকে নেওয়া ) – ১ কাপ
বিকালেঃ
পুডিং বা ফিরনী – হাফ কাপ
চা – ১ কাপ
রাতেঃ
নরম ভাত – ১ কাপ
মুরগির বাচ্চার মাংস বা অন্য চর্বিহীন মাছ – ২ টুকরা
দই-চিনি – ১ কাপ
বেশী রাতেঃ
হরলিকস বা ওই জাতীয় পানীয় – ১ গ্লাস
আরো পড়ুনঃ
আলসারে ভুগলে জেনে নিতে পারেন তার চিকিৎসা
3 Comments