পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতার এবং বিভিন্ন জেলার লোভনীয় মিষ্টির কথা
কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টি


১) রসগোল্লা- বাগবাজার, কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতার এবং বিভিন্ন জেলার লোভনীয় মিষ্টির মাঝে রসগোল্লা অন্যতম। রসগোল্লা দেখতে গোলাকার এবং সাদা রঙের এক প্রকার ছানার মিষ্টি। সবার কাছেই রসগোল্লা একটি জনপ্রিয় মিষ্টি। এটি চিনি বা গুড় এবং ছানা দিয়ে তৈরি হয়। ছানা (তার মধ্যে অনেক সময় সুজির পুর দেওয়া হয়) পাকিয়ে গরম রসে ডুবিয়ে এটি প্রস্তুত করা হয়। রসগোল্লার উৎপত্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার বিরোধ বহু দিনের। নভেম্বর ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রসগোল্লার জিআই ট্যাগ লাভ করে। ফলে রসগোল্লার উৎপত্তি যে বাংলায় তা প্রতিষ্ঠিত হয়।রসগোল্লা কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায় এবং এটি সবার কাছে খুব বেশি সমাদৃত।

২) ল্যাংচা- শক্তিগড়, বর্ধমান ও তারাপীঠ, বীরভূম
কলকাতায় বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি পাওয়া গেলেও ল্যাংচা কলকাতার একটি লোভনীয় মিষ্টি। ল্যাংচা কালো খয়েরি রঙ্গয়ের হয়ে থাকে। এটি একটি রসের মিষ্টি। ল্যাঙ্গচা সাধারণত কলকাতার শক্তিগড়ে পাওয়া যায়। এছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে এই শক্তিগড়ের মতো ল্যাংচা এখন তৈরী করা হয়।

৩) সরপুরিয়া ও সরভাজা- কৃষ্ণনগর, নদীয়া
সরভাজা কলকাতার কৃষ্ণনগরের একটি বিখ্যাত মিষ্টি।দুধের সর দিয়ে এই মিষ্টি তৈরী করা হয়। দূর্গা পুজাতে যেমন দেবীকে ভোগ,মায়ের পূজাতে যেমন দেবীকে আমিষ উতসর্গ করা হয় তেমনি জগদধাত্রী পূজাতে এই কৃষ্ণনগরের সরভাজা দেবীকে উতসর্গ করা হয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে এই মিষ্টির প্রচলন থাকলেও এই পূজার সময়ে সরপুরিয়ার কদর একটু বেশীই থাকে।

৪) সীতাভোগ ও মিহিদানা- বর্ধমান, পূর্ব বর্ধমান
বর্ধমানের সীতাভোগ বাংলার এক সুপ্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন।সীতাভোগ এবং মিহিদানা শুধু বর্ধ্মান অঞ্চলেই প্রচলিত না এছাড়াও ভারত বর্ষের বিভিন্ন এলাকায় এই মিষ্টির অনেক প্রচলন। এটা অনেকটা বাসমতী চালের ভাতের মত দেখতে হয়।বর্ধমানের মিহিদানা বাংলার আর এক সুপ্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন এবং দেশের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন হিসেবে স্বীকৃত। মিহিদানার পেটেন্ট আইনিভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে প্রদান করা হয়েছে।

৫) মোয়া- জয়নগর, দক্ষিণ ২৪ পরঘনা
জয়নগরের মোয়া কলকাতার একটি বিখ্য়াত মিষ্টান্ন।এটি হল কনকচূড় ধানের খই, খেজুর গুড় ও গাওয়া ঘিয়ের তৈরী একটি অতি জনপ্রিয় মিষ্টান্ন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগর শহর এই মিষ্টান্নটির জন্য খুব বিখ্যাত । জয়নগর শহরের পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকিবাবু এবং নিত্যগোপাল সরকারকে জয়নগরের মোয়ার বাণিজ্যিক বিপণনের পথিকৃৎ বলে ধরা হয়।

৬) কদমা- মানকর, পূর্ব বর্ধমান
কদমা বাংলার একটি শুকনো মিষ্টি । কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টির মাঝে প্রায় সব মিষ্টিই রসালো কিন্তু এই কদমা, বাতাসা, নকুলদানা রসছাড়া মিষ্টি তাই বলে যে এগুলো যে বিখ্যাত না তা না এগুলোও কলকাতা শহরে বিখ্যাত। বাংলায় অনেক পুরনো মিষ্টির মধ্যে কদমা, বাতাসা, নকুলদানা অন্যতম। বাংলায় অতিথি আপ্যায়নে কদমা অনেক পুরনো রীতি। যদিও এখন আর এই মিষ্টির আগের মতো নেই। তবে পূজার কাজে এখনও বহুল ব্যবহার আছে। বিশেষত কালী পূজায় কদমার ব্যবহার বেশি।

৭) মনোহরা- জনাই, হুগলী।
মনোহরা পশ্চিমবঙ্গের এক অতি জনপ্রিয় মিষ্টি। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার জনাইয়ের ও মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙার মনোহরা অতি প্রসিদ্ধ। একে অনেক জায়গায় চাউনি সন্দেশও বলা হয়। মনোহরা হল ছানা ও চিনির অথবা সরচাঁছি ও ক্ষীরের মিশ্রণের গোল্লার উপর চিনির স্তর দেওয়া একটি গোলকাকৃতি মিষ্টি। সাম্প্রতিক কালে কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক গিরীশচন্দ্র দে ও নকুলচন্দ্র নন্দী চিনির বদলে নলেন গুড়ের প্রলেপ দেওয়া মনোহরার প্রচলন করেন।

৮) জলভরা- তালশাঁস, চন্দননগর্
জল্ভরা সন্দেশ কলকাতার একটি লোভনীয় সন্দেশ। কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় এই সন্দেশের প্রচলন প্রাচীন কাল থেকে। এটি তালশাঁস আকৃতির কড়াপাকের এক বিশেষ সন্দেশ। হুগলি জেলার সূর্যকুমার মোদক এই মিষ্টির আবিষ্কারক। সন্দেশ বানানোর মূল উপাদান ছানা, চিনি, গোলাপজল ও শীতকালে নলেন গুড়। সূর্য মোদকের দোকানে গোলাপজল আসে প্রতিদিন কৌনজ থেকে। কিছুটা সন্দেশ প্রথমে ছাঁচের মধ্যে দিয়ে আঙুলের চাপে একটা গর্ত করে নেওয়া হয়। সেই গর্তে গোলাপজল ঢেলে আবার সন্দেশ দিয়ে বাকিটা ঢেকে ছাঁচের মুখ বন্ধ করে দিতে হয়। এভাবেই জলভরা সন্দেশ তৈরী করা হয়।

৯) লালদই- নবদ্বীপ, নদীয়া
লাল দই বা ক্ষীর দই বাংলার অন্যতম প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন। দই বা দধি মিষ্টান্ন পরিবারের কুলীন সদস্য। দই সাধারনত সাদা হলেও লাল দই একটি স্বতন্ত্র উপাদেয় মিষ্টান্ন। ১৯৩০ সালের দিকে নবদ্বীপের জনৈক কালিপদ মোদক, মতান্তরে কালী ঘোষ, এই দই প্রথম প্রস্তুত করেন। ১৫০ বছরেরও প্রাচীন পাঁচুর মিষ্টির দোকান ‘লক্ষ্মী নারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ অন্যতম বিখ্যাত লাল দইয়ের দোকান। দই তৈরি করার পর দশদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

১০) রসকদম্ব- মালদহ
রসকদম্ব বা রসকদম বাংলার এক বিখ্যাত মিষ্টি। রসকদম্বের ভেতরে থাকে ছোট একটি রসগোল্লা আর তার উপর থাকে ক্ষীরের পুরু স্তর। তারও উপরে থাকে চিনি মাখানো পোস্ত দানা। এতে রসকদম্বকে অবিকল কদম ফুলের মত দেখতে লাগে। এটি পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। রসকদম্বের মূল উপাদান ছানা, ক্ষীর, চিনি ও পোস্ত। প্রথমে ছানা দিয়ে মাঝারি থেকে ছোট আকারের রসগোল্লা তৈরী করা হয়। তারপর দানাদার তৈরী করার মত করে রসগোল্লা থেকে বাড়তি রস ঝেড়ে ফেলা হয়। এই রসগোল্লায় লাল রঙ দেওয়া হয় ও ভ্যানিলা এসেন্স যোগ করা হয়। তারপর রসগোল্লাকে গুঁড়ো খোয়া ক্ষীরের আস্তরণে ঢেকে ফেলা হয়। সব শেষে মাঝারি রকমের ভাজা পোস্তর একটি প্রলেপ দিয়ে মিষ্টিটাকে কদম ফুলের মত দেখতে করা হয়। ফ্রিজে না রাখলেও এই মিষ্টি সাত দিন পর্যন্ত টাটকা থাকে। পোস্তর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক পোস্তর পরিবর্তে চিনির দানা ব্যবহার করেন। কেউ কেউ পোস্তর পরিবর্তে ক্ষীরের গুঁড়ো ব্যবহার করেন।

১১) মোরব্বা- সিউড়ী, বীরভূম
মোরব্বা হলো খুব ঘন চিনির রসে ডোবানো একপ্রকার মিষ্টান্ন যা সাধারণত কোনো সবজিকে বিশেষভাবে জারিত করে প্রস্তুত হয়। যেমন: পেপের মোরব্বা, কুমড়োর মোরব্বা, পটলের মোরব্বা, শতমূলীর মোরব্বা ইত্যাদি।

১২) মেচা সন্দেশ- বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া
ম্যাচা বা মেচা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার এক জনপ্রিয় মিষ্টি। একে অনেক সময় ম্যাচা সন্দেশও বলা হয়। বেলিয়াতোড়ের ম্যাচা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ এবং সব চেয়ে উৎকৃষ্ট বলে গণ্য করা হয়। মুগডাল ও চিনি দিয়ে ম্যাচা তৈরী করা হয়। প্রথমে মুগডালবাটার সাথে চিনি মিশিয়ে ঠিকমতো পাক করে গোল্লা পাকানো হয়। পরে এর উপর একটি চিনির প্রলেপ দেওয়া হয়। ম্যাচা দেখতে অনেকটা মনোহরার মত। পূর্বে ম্যাচার জনপ্রিয়তা বর্তমানে অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে, বর্ধমানের উপকন্ঠে নবনির্মিত মিষ্টি হাবে, পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য মিষ্টির সাথে ম্যাচাও উৎপাদিত হবে।

১৩) ছানাবড়া- বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
লালবাগের ছানাবড়া বাংলার মিষ্টির মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত। মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ শহরে এই মিষ্টির আবির্ভাব। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই মিষ্টি আবিষ্কার হয় বলে মনে করা হয়। লালবাগের এক মিষ্টির দোকানের মালিক ছিলেন নিমাই মণ্ডল। তার হাত ধরেই ছানাবড়ার পথ চলা শুরু। তাঁর দোকান থেকেই নবাবের প্রাসাদে নিয়মিত ছানাবড়া সরবরাহ করা হতো। রুপোর থালায় এক মণ বা দেড় মণ সাইজের পেল্লায় ছানাবড়া সাজিয়ে নবাবরা অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতেন এবং এতে অতিথিদের চোখ নাকি ছানাবড়া-ই হয়ে যেত। সেই থেকেই চোখ ছানাবড়া কথাটার উদ্ভব। আগে এই মিষ্টিটি মুর্শিদাবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও খাগড়ার সোনাপট্টি এলাকার মিষ্টি ব্যবসায়ী পটল সাহা বা পটল ওস্তাদের হাত ধরেই ছানাবড়া মুর্শিদাবাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কাশিমবাজারের রাজা শ্রী মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ছিলেন ছানাবড়ার পৃষ্ঠপোষক।

১৪) সাদা বোঁদে – কামারপুকুর, হুগলী
কামারপুকুরের সাদা বোঁদে পশ্চিমবঙ্গের স্বতন্ত্র ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই মিষ্টান্ন। প্রচলিত বোঁদের সাথে এই বোঁদের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কামারপুকুরের সাদা বোঁদের প্রধান উপাদান রমা কলাইয়ের বেসন ও আতপ চালের গুঁড়ো। তার সাথে লাগে গাওয়া ঘি বা বনস্পতি ও চিনির রস। রমা কলাই বা রম্ভা কলাই বলতে বরবটির বীজকে বোঝানো হয়। সেই জন্য রমা কলাইয়ের বেসনকে বরবটির বেসনও বলে। অতীতে কামারপুকুরের স্থানীয় চাষীরাই বরবটি চাষ করে পাকা বরবটির বীজের জোগান দিতেন। সেই বরবটির বীজ অর্থাৎ রমা কলাইকে প্রথমে জলে ধুয়ে তারপর রোদে শুকিয়ে নেওয়া হত। এর পর সেই শুকনো কলাইকে পিষে বেসন তৈরি করা হত। বর্তমানে কামারপুকুরের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা কলকাতার বড়বাজার থেকে রমা কলাইয়ের বেসন আনান। আতপ চালের ক্ষেত্রে মেশিনে গুঁড়ো করা আতপ চালের থেকে ঢেঁকিতে গুঁড়ো করা আতপ চাল শ্রেয় কারণ, তাতে স্বাদ বেশী হয়। অতীতে সাদা বোঁদে ভাজা হত গাওয়া ঘিতে। কিন্তু খরচে পোষাতে না পেরে অধিকাংশ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী বনস্পতি ঘি বা ডালডা ব্যবহার করেন। কোন কৃত্রিম রঙ ব্যবহার করা হয় না।

১৫) কাজু বরফী- কাঁথী, পূর্ব মেদিনীপুর
মেদিনীপুর জেলার কাঁথীর কজু বরফী বাংলায় বেশ জনপ্রিয়। ভারতের নানা জায়গায় এই মিষ্টি পাওয়া গেলেও কাঁথীর কাজু বরফীর স্বাদই আলাদা। প্রায় ৮৫ বছর আগে কাঁথিতে এই মিষ্টি প্রথম তৈরি করেন প্রয়াত মিষ্টি ব্যবসায়ী কালাচাঁদ প্রধান বা কালু ময়রা।
প্রথমে কাজুবাদামকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গুঁড়ো করা হয়। তারপর সেই গুঁড়ো দিয়েই তৈরি করা হয় মিষ্টি। আর স্বাদের জোরেই এই মিষ্টি মন কেড়েছে বিদেশের মানুষেরও। টোকিও, নিউ ইয়র্ক, লাস ভেগাস, মালয়েশিয়া এমনকী প্যারিসেও রফতানি হয়েছে এখানার মিষ্টি।

১৬) মুগের জিলিপি- কেশপুর ও ডেবরা, পশ্চিম মেদিনীপুর
মুগের জিলিপি বাঙালিদের মধ্যে এক জনপ্রিয় মিষ্টি। সাধারণ জিলিপি তৈরিতে যে উপাদান ব্যবহার করা হয় তার পরিবর্তে এই জিলিপিতে মুগের ব্যবহার মিষ্টিতে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। মুগডাল উপাদানের জন্য এই মিষ্টি সাধারণ জিলিপি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি মিষ্টিতে পরিণত হয়েছে। মুগের জিলিপির প্রধান উপকরণ মুগ ডাল, ঘি ও চিনি। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর ও ডেবরার মুগের জিলিপি বিখ্যাত।

১৭) ক্ষীরপাই এর বাবরসা, পশ্চিম মেদিনীপুর
বাবরসা বা বাবরশা হল পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার (বর্তমানে ঝাড়গ্রাম জেলা) (ভুল, এটি প: মেদিনীপুর জেলারই একটি ব্লক)ক্ষীরপাই এলাকার একটি মিষ্টি। এই মিষ্টির উৎপত্তি স্থান হল ক্ষীরপাই।
মূলত ময়দা, দুধ, ঘি দিয়ে তৈরি হয় বাবরসা। তবে এখন এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে ঘিয়ের বদলে ডালডাতেই ভাজা হয় এই মিষ্টি। ছাঁচে ফেলে ভেজে রাখা হয়। এর পর খাওয়ার সময় তাতে রস ঢেলে পরিবেশন করা হয়। আগে অবশ্য মধুতে ডুবিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। জানা যায়, ১৭৪০-১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় বর্গিরা একাধিকবার ক্ষীরপাই শহর আক্রমণ করে। বর্গিদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এলাকা ছাড়তে শুরু করেন বাসিন্দারা। সেই সময় এডওয়ার্ড বাবরশ নামে এক সাহেব বর্গিদের হঠিয়ে দেন। স্বস্তি ফেরে শহরে। এই ঘটনার পর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ স্থানীয় এক মিষ্টি ব্যবসায়ী ‘বাবরশা’ নামে একটি খাবার তৈরি করে এডওয়ার্ডকে উপহার দেন। সেই থেকেই শহরের মানুষের পছন্দের মিষ্টির তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বাবরসা।

১৮) ক্ষীরদই- গঙ্গারামপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর
বাঙালীর মিষ্টি প্রেমে দই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তবে তা শুধু অনুষ্ঠান বাড়ির অপরিহার্য উপাদান বলে নয়। অসাধারণ স্বাদ আর মাখনের মত পেলবতা দইকে করে তুলেছে আরও উৎকৃষ্ট। আর এই দই যদি হয় দক্ষিণ দিনাজপুরের দই তাহলে তো আর কথাই নেই।

১৯) রসমালাই- রামপুরহাট, বীরভূম
রসমালাই-নাম শুনলেই জিভে জল আসে। সুস্বাদু এই মিষ্টান্নের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও। রসমালাই বাংলার অতি বিখ্যাত মিষ্টান্ন। ছোট ছোট আকারের রসগোল্লাকে চিনির রসে ভিজিয়ে তার ওপর জ্বাল-দেওয়া ঘন মিষ্টি দুধ ঢেলে রসমালাই বানানো হয়। বাংলাই রসমালাইয়ের উৎপত্তিস্থল। দাবী করা হয়, ১৯৩০ সালে রসগোল্লার থেকেও উন্নততর করে এই মিষ্টির নাম রসমালাই রাখা হয়। বাঙালি ময়রা কৃষ্ণচন্দ্র দাস প্রথম রসমালাই তৈরি করেন। তবে এই দাবির স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

২০) ছানার পায়েস- রায়গঞ্জ, দক্ষিন দিনাজপুর
বাঙালির খাদ্য তালিকায় পায়েসের জুরি মেলা ভার। যে কোনও অনুষ্ঠান হোক বা উৎসব সবেতেই পায়েস বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। তাই এই অনেকেই পায়েসের নিত্য নতুন উপকরণ দিয়ে বানিয়ে অন্য মাত্রা যোগ করেছে।

২১) পান্তুয়া- রানাঘাট, নদীয়া
পান্তুয়া এক রকমের ছানা দিয়ে তৈরি একটি মিষ্টি। প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের বেশকিছু জায়গায় এটি তৈরি করা হয়ে থাকে। ছানা, দুধ, ঘি ও চিনি দ্বারাই প্রধানত এটি তৈরি হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে কাটোয়া, কালনা ও রানাঘাটে পান্তুয়া বিখ্যাত।
ছানাকে ভালো করে বেটে নিতে হবে। এরপর বেটে নেওয়া ছানার সাথে ঘি, ময়দা, সোডা, গুড়, এলাচ গুঁড়ো একসঙ্গে মিশিয়ে নেওয়া হয়। এরপর মিশ্রণটিকে ভাল করে মেখে হাতের চাপে গোল গোল বল বানিয়ে নিয়ে ডোবা তেলে ভেজে গরম রসে ফেলা হয়। ভাল করে রস ঢুকে গেলে ঠান্ডা অবস্থায় পরিবেশন করা হয়।

২২) চমচম- বেলাকোবা, জলপাইগুড়ি ।
বেলাকোবার চমচম পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে এক অতি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। বেলাকোবার চমচম এক বিশেষ ধরনের মিষ্টি। এটি সাধারণ চমচম থেকে আলাদা। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির বেলাকোবা নামক স্থানে এই বিশেষ প্রকৃতির চমচম প্রথম তৈরি হয় বলেই এই মিষ্টি বেলাকোবার চমচম নামে প্রসিদ্ধ। এটি ছানার তৈরি একপ্রকার মিষ্টি জাতীয় খাবার। বেলাকোবার চমচমের প্রধান উপাদান ছানা, ময়দা, চিনির রস ও খোয়া ক্ষীর। পোড়াবাড়ির চমচমের ঘরানার সাথে বেলাকোবার চমচমের ঘরানার কতকগুলি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পোড়াবাড়ির চমচমের বৈশিষ্ট হলো কড়াপাক। কিন্তু, বেলাকোবায় চমচমে কড়াপাকের সাথে যুক্ত হয় অধিক পরিমাণে ক্ষীর। পেল্লাই আকারের গোলাপি চমচমে বরফের কুচির মত ছড়িয়ে দেওয়া হয় ক্ষীরের দানা।

২৩) নিখুঁতি- শান্তিপুর, নদীয়া
নিখুঁতি (বানানভেদে নিখুতি বা নিকুতি) বাংলার এক অতি জনপ্রিয় মিষ্টি। গঠনগত দিক থেকে নিঁখুতি একটি পান্তুয়া জাতীয় মিষ্টি। এটি আকৃতিতে লম্বাটে, খানিকটা ল্যাংচার মত। এর বাইরেটা শক্ত কিন্তু ভেতরটা নরম। পরিবেশনের সময় নিখুঁতির উপর হালকা গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। নিখুঁতির পায়েসও ভীষণ জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুরের নিখুঁতি অতি বিখ্যাত। শান্তিপুর ছাড়া কৃষ্ণনগর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়াতেও নিখুঁতি মেলে। ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নদীয়া জেলার পর্যটন উন্নয়নের জন্য শান্তিপুরের নিখুঁতিকে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে তুলে ধরে।

২৪) প্যাড়া- ছাতনা, বাঁকুড়া
শত বছর ধরে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে প্যাড়া সন্দেশের ইতিহাস। প্রথমে শুধু দেব-দেবীর আরাধনায় মিষ্টান্নর প্রয়োজন এই উদ্দেশ্যেই সন্দেশ তৈরি করা হতো। পরবর্তীতে সর্বসাধারণের জনপ্রিয় মিষ্টান্নে পরিণত হয়েছে। মহেন্দ্রী দাস নামের এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায় তৈরি করা শুরু করেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ছাতনার প্যাড়া বেশ প্রসিদ্ধ।

২৫) ছানার জিলিপি- অগ্রদ্বীপ (কাটোয়া), বর্ধমান
ছানার জিলিপি বাংলার মিষ্টির মধ্যে অন্যতম। নদীয়ার মুড়াগাছা অঞ্চলে এই মিষ্টান্নটির উত্পত্তি। কবিকঙ্কনের ‘চন্ডীমঙ্গল’-এ ছানার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই ছানার বিভিন্ন মিষ্টির মধ্যে এটি অন্যতম কুলীন মিষ্টান্ন। পান্তুয়া গোত্রের এই মিষ্টিটি নদীয়ার মুড়াগাছা ছাড়াও মেদিনীপুরের মেচেদা ও পাশকুড়ার পাওয়া যায়। এছাড়াও কলকাতার ভূপতি রায়ের দোকানের ছানার জিলিপি বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে ভূপতি রায়ের দোকান আর নেই।

২৬) ছানার মুড়কি- নন্দীগ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর
পূর্ব মেদিনীপুর: মিষ্টির শহর মহিষাদলের সেরা মিষ্টি ছানার মুড়কি। দেশি গরুর খাঁটি দুধ থেকে তৈরি করা হয় ছানার মুড়কি। চারকোনা, ছোটো, হাল্কা এবং শক্ত। ওপরে জমাট বাঁধা চিনির প্রলেপ থাকে। কোথাও কোথাও ছানার ছানামুখী নামেও পরিচিত। ব্রিটিশ আমল থেকেই এর খ্যাতি নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কথিত আছে, প্রায় একশো বছর আগে প্রথম ছানার মুড়কি তৈরি করেছিলেন মহাদেব পাঁড়ে। আদতে তিনি কাশীর বাসিন্দা। বড়ো ভাই দুর্গাপ্রসাদের মিষ্টির দোকান ছিল কলকাতায়। সেখানেই কাজ করতেন কিশোর মহাদেব। হঠাৎ দুর্গাপ্রসাদ মারা গেলেন। নিরাশ্রয় হয়ে মহাদেব ঘুরে বেড়াতে লাগলেন নানা জায়গায়। ওই সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেড্ডা অঞ্চলে শিবরাম মোদকের মিষ্টির দোকান ছিল। সেখানে চাকরি এবং আশ্রয় পেলেন মহাদেব। তিনি কাজ শুরু করার পর দোকানেরও খুব প্রতিপত্তি হল। তাঁর মিষ্টি তৈরির হাত ছিল দারুণ। খেয়ে তো সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শিবরাম মারা যাওয়ার আগে মিষ্টির দোকানটি মহাদেবকে দিয়ে যান। ছানামুখী বানিয়ে মহাদেব যেমন স্মরণীয় হয়ে আছেন, তেমনি লেডিকেনিরও স্রষ্টা তিনি। বড়োলাট লর্ড ক্যানিং-কে খুশি করতে মহাদেব বিশেষ ধরনের মিষ্টি তৈরি করে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন। বড়োলাট এবং তাঁর স্ত্রী – দু’জনেই মিষ্টি খেয়ে অভিভূত।

২৭) মন্ডা ও মিঠাই- প্রেমের ডাঙ্গা, কোচবিহার
ভূতের রাজার বরে তালি বাজিয়ে মন্ডা-মিঠাই পেয়েছিল গুপি-বাঘা। তখন তার আলাদা কদর। সেই ‘হুন্ডি’-ও নেই। হারিয়েছে মন্ডার সেই স্বাদও।
উত্তর কলকাতার কয়েকটি বাঁধা দোকান এবং দক্ষিণবঙ্গের বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার কয়েকটি অঞ্চল ছাড়া মন্ডার দোকান মেলা ভার। উত্তরবঙ্গে কেবল জেগে আছে কোচবিহারের ছোট্ট গঞ্জ প্রেমেরডাঙার একটি দোকান।
মণ্ডা গোল চ্যাপ্টা আকৃতির বাঙালি মিষ্টান্ন। দেখতে অনেকটা পেঁড়ার মত। ‘মিঠাই-মণ্ডা’ একটি বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ। সাধারণত কড়াপাকের চিনি মেশানো ক্ষীরের তাল পাকানো গোল মণ্ডকে পরিষ্কার শক্ত কোন তলে বিছানো কাপড়ের ওপর হাত দিয়ে ছুঁড়ে সাধারণত ভাবে চ্যাপ্টা করার কাজটি করা হয়। পরে ঠাণ্ডা হলে শক্ত হয়ে যায় ও তখন কাপড় থেকে খুলে নেওয়া হয়। তাই যেদিকটা নীচে (কাপড়ে লেগে) থাকে, সেটা পুরো সমতল হয়, আর অন্য দিকটা একটু উত্তল আর কিনারা একটু ফাটা ফাটা হয়। ক্ষীরের রঙের ওপর নির্ভর করে মণ্ডা সাদা বা ঈষৎ হাল্কা খয়েরি রঙের হয়। (আসলে চিনিকে বেশী গরম করলে পুড়ে বা ক্যারামেলাইজ হয়ে খয়েরি রং ধরে)। মণ্ডা সাধারণ ভাবে কাগজে মুড়ে বিক্রি করা হয়।

২৮) লালমোহন / গোলাপ জাম- ফুলবাড়ি, শিলিগুড়ি
জনপ্রিয় মিষ্টি গোলাপ জামুন। এটি লালমোহন নামেও পরিচিত। মিষ্টিটি দেখতে অনেকটা জামের মতো তাই এর নামের সঙ্গে ‘জাম’ যুক্ত হয়েছে। এই মিষ্টি ছোট হতে বৃদ্ধ প্রায় সকল বয়সের মানুষ খেতে পছন্দ করে।
শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া জলপাইগুড়ি জেলার ফুলবাড়িতে বছরের পর বছর ধরে বাজিমাত করে চলেছে লালমোহন। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন লালমোহন আবার কে? চমকাবেন না। লালমোহন আসলে একটি মিষ্টির নাম। আজ থেকে সত্তর বছর আগে যখন ফুলবাড়িতে লোকজন বলতে প্রায় কেউই ছিল না, তখন দেশভাগের পর ময়মনসিংহ থেকে আসা প্রয়াত মণীন্দ্রমোহন ঘোষ এই ‘লালমোহন’ নামক মিষ্টির জন্ম দেন। ওপার বাংলায় এ-ধরনের মিষ্টি থাকলেও, এপার বাংলায় নেই। তাই কার্যত ফুলবাড়ি দিয়েই এর ইতিহাস তৈরি হয়। এখন মণীন্দ্রবাবু না থাকলেও তাঁর ছেলে এই মিষ্টির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

২৯) কানসাট- মালদহ
মালদহের কানসাট বাংলার আশ্চর্য মিষ্টান্নের অন্যতম। ইন্দিরা গান্ধী মালদায় এসে কানসাট খেয়ে গণি খান চৌধুরীকে একবার বলেছিলেন, দিল্লিতে যতবার আসবে কানসাট নিয়ে আসবে। তারপর থেকে গণি পরিবারে বড় মাপের কোনো অতিথি এলে কানসাট চাই-ই। গণি খান চৌধুরী বেঁচে থাকাকালীন সেই রেওয়াজ ছিল। আজ তিনি নেই, তবুও কানসাট যাওয়া বন্ধ হয়নি। এই মিষ্টি পাতে না পড়লে নাকি ঠিকমতো অতিথি অ্যাপায়ন হয় না। মালদার এই মিষ্টি এখন বিদেশেও জনপ্রিয়। বিশেষত তার মনভোলানো স্বাদের জন্য। প্রবাসী বাঙালি ঘরে ফিরলে কানসাটের সামনে লম্বা লাইন পড়ে। টাটকা মিষ্টি তার চাই-ই।
দেশ ভাগের পর ১৯৪৭ সালে ওপার বাংলার শিবগঞ্জ জেলায় কানসাট অঞ্চল থেকে দলে দলে মিষ্টি কারিগররা মালদায় চলে আসেন। কানসাটে প্রসিদ্ধ মিষ্টি ব্যবসায়ী মহেন্দ্রনাথ সাহার পুত্র বিজয় কুমার সাহা বাবার শেখানো পথে এপারে এসে বাংলার মালদহে এসে কানসাটের যাত্রা শুরু করেন। কানসাটের উপাদান ভালো ক্ষীর হলেও ছানার গুণমানের ওপরেও এর স্বাদ নির্ভর করে। ভাল করে ঠিক ঠাক জাল হলে সেই জালের উপরে ভাজা ক্ষীর বা খোয়া ক্ষীর ছড়িয়ে দিলেই তৈরি হয় কানসাট। ঠিক মতন জাল দেওয়ার ওপরই নির্ভরকরে মিষ্টির ভেতরে কতটা মৌমাছির চাকের মতো চাক দেখা যাবে। আর জাল দেওয়ার ভাল-মন্দ নির্ভর করে আঁচের উপর। সাহাদের বিখ্যাত কানসাট এই আঁচের অভিজ্ঞতার ওপরেই স্বাদ তৈরী করে মন জয় করেছে। তবে পুরনো বা বাসি হলেই এর আসল স্বাদ হারিয়ে যাবে।

৩০) কমলাভোগ- মাদারিহাট, আলিপুরদুয়ার
মাদারিহাটের কমলাভোগ পশ্চিমবঙ্গের মিষ্টির মধ্যে অন্যতম। রসগোল্লার থেকে আকারে সামান্য বড় কমলাভোগ নামের কারণ এই মিষ্টিতেও কমলালেবু ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রচলিত ফল মিশিয়ে বা ফলকেও ছানার সাথে ব্যবহার করে যে সকল মিষ্টি তৈরী করা হয়, তাদের মধ্যে কমলাভোগের সমাদর আছে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে ডুয়ার্স এবং তরাই অঞ্চল থেকে এই মিষ্টির পথ চলা। কলকাতার ভীমচন্দ্র নাগ রস জাতীয় মিষ্টির মধ্যে কমলাভোগের সুনাম আছে। জি আই ট্যাগের জন্য কমলাভোগের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে।

৩১) মতিচুড়ের লাড্ডু- বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
‘লাড্ডু’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘লাড্ডুকা’ বা ‘লাত্তিকা’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘ছোট বল’। আর হিন্দিতে ‘মতি’ শব্দের অর্থ ‘মুক্তা’। ‘চুর’ অর্থ ‘ভাঙা’ বা ‘চূর্ন-বিচুর্ন’ করা। অর্থাৎ ‘মতিচুর’ মানে ‘মুক্তার ভাঙা গুঁড়া’। ছোট ছোট মুক্তা দানার মতো বুন্দিয়া বানিয়ে সেগুলোকে একসাথে হাতে চেপে তৈরি হয় মতিচুরের লাড্ডু। আর এইজন্যই এমন চমৎকার নামের উৎপত্তি। মতিচুরের লাড্ডু ভারত উপমহাদেশের একটি প্রাচীন মিষ্টি। এর বয়স দু’হাজার বছরেরও বেশি। মনে করা হয়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে বিহারে এই মিষ্টির উৎপত্তি হয়।

৩২) দরবেশ-বর্ধমান
দরবেশ বাংলার তথা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের অন্যতম জনপ্রিয় মিষ্টান্ন। এটি মূলত বোঁদে থেকে তৈরি হওয়া লাড্ডু। এই লাড্ডুতে লাল, হলুদ ও সাদা এই তিন রঙের বোঁদে ব্যবহার করা হত। দরবেশদের আলখাল্লা নানা রঙের হয়ে থাকে। এখন যেহেতু এই লাড্ডুও নানা রঙের বোঁদে দিয়ে তৈরি হত, তাই এর নাম রাখা হয় দরবেশ। বর্তমানে দরবেশ সধারণত লাল ও হলুদ রঙের বোঁদে দিয়েই তৈরি করা হয়।

৩৩) গুপো সন্দেশ- গুপ্তীপাড়া, পানিহাটি
গুপো সন্দেশ পশ্চিমবঙ্গের একটি জনপ্রিয় মিষ্টি। গুপো সন্দেশের বৈশিষ্ট্য হল যে এটি শুধুমাত্র গরুর দুধের ছানা থেকেই তৈরি হয়। গুপো সন্দেশ হল মাখা সন্দেশ থেকে প্রস্তুত এবং পাশাপাশি চেপে লাগানো এক জোড়া গোলাকৃতি সন্দেশ। গুপো সন্দেশকে বাংলার প্রথম ব্র্যান্ডেড মিষ্টি বলে মনে করা হয়।
কথিত আছে, হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়াতেই সন্দেশের জন্ম। এখানেই প্রথম তৈরি হয় সন্দেশের মিশ্রণ, যা মাখা সন্দেশ নামে পরিচিত। পরে সেই মাখা সন্দেশকেই আকার দিয়ে তৈরি হয় গুপো সন্দেশ। গুপো সন্দেশ কালক্রমে কলকাতার অভিজাতদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়। উৎসবে অনুষ্ঠানে কলকাতার অভিজাতরা গুপ্তিপাড়ায় ছুটতেন গুপো সন্দেশ কিনতে। ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে পানিহাটির গুপো সন্দেশ কলকাতায় খুব জনপ্রিয় হয়।

৩৪) কাস্তার লাড্ডু- কাশিপুর, পুরুলিয়া।
কাস্তার লাড্ডু বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন। পঞ্চকোট রজ্যের রাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেওয়ের পৃষ্ঠপোষকতার এই মিষ্টির প্রচলন হয়। মিষ্টান্নপ্রিয় রাজার রসনা তৃপ্তির কথা ভেবে লাড্ডু বানানো হয়। এই মিঠাই কাশিপুর এবং সংলগ্ন অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও তেমন পরিচিত নয়। বিলুপ্তপ্রায় এই লাড্ডু দু’চারটি মিষ্টির দোকানে এখনও পাওয়া যায়। পঞ্চকোট রাজবংশের এক সদস্য সোমেশ্বর লাল সিংহ দেও জানান, “রাজবাড়িতে বিজয়ার মিষ্টিমুখে এই লাড্ডু প্রজাদের বিলি করতেন রাজা। লাড্ডু তৈরির সময় গাওয়া ঘিয়ের গন্ধে এলাকা ম-ম করত।” কাস্তার মিঠাই এর প্রধান উপকরণ ছানা, ক্ষীর (ক্ষীর), বেসন, ময়দা (বা আটা), এলাচ, জায়ফল, জয়িত্রি, কাজু, কিসমিস।
এই লাড্ডুটি মানভূম তথা পঞ্চকোট রাজ-পরিবারের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। এটা অন্য কোথাও মেলে না। কাশীপুরের হাতে গোনা দু’একটি দোকানে এই মিঠাই তৈরি হয়। এর রেসিপি কাশীপুর এলাকাতে পুরনো দিনের কয়েকজনই শুধু জানেন।
5 Comments