
বাঙালিদের মিষ্টিমুখের কথা আসলে মিষ্টি চাই ই চাই। অর্থাৎ যাকোন সুখবর যেকোন শুভ অনুষ্ঠানে বাঙালিদের মিষ্টি ছাড়া চলেই না। বাঙ্গালিরা মিষ্টি ভালোবাসে না এমন কারো যেন দেখাই যায় না।
বাংলার প্রত্যেকটি জেলায় আলাদা আলাদা সুস্বাদু মিষ্টি পাওয়া যায়। বাংলার প্রায় সব জেলাই এসব বিখ্যাত মিষ্টির জন্য জনপ্রিয়। বাঙালির শেষ পাতে মিষ্টি ছাড়া যেন খাবার সম্পূর্ণই হতে চায় না।
বাংলার এসব বিখ্যাত মিষ্টি আমরা প্রায় সবাই চিনি। এর মাঝে কোন কোন মিষ্টি আবার আমরা নাও চিনে থাকতে পারি। তাই আসুন পরিচিত হয় বাংলার বিখ্যাত মিষ্টি্র সাথে।
১। যশোরের জামতলার রসগোল্লা

বাংলাদেশের যশোর জেলার ছোট একটি বাজার জামতলা। শুধুমাত্র এই রসগোল্লার কারণেই যশোরের জামতলার নাম দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের প্রায় সব জায়গাতেই রসগোল্লা বানানো হয়। কিন্তু যশোর জেলার রসগোল্লার স্বাদ ও গন্ধে অনন্য।
জামতলা বাজারের সাদেক আলী নামের একজন প্রথম এই মিষ্টির প্রচলন শুরু করেন। তার নামানুসারে এই মিষ্টির নাম দেওয়া হয় সাদেক গোল্লা।
জামতলার এই রসগোল্লা প্রথমে দেশী গরুর ছানা দিয়ে ছোট ছোট গোল্লা বা বল করা হয়। এরপর মৃদু আচে এই বলগুলোকে চিনির সিরায় ফুটিয়ে সিদ্ধ করা হয়। সেগুলো বাদামী বর্ণের হয়ে এলে তৈরী হয়ে যায় রসগোল্লা।
জামতলার রসগোল্লার মূল প্রস্তুতকারক সাদেক আলীর ছেলে জানান-
” চুলা ও পাত্র অন্যত্র নিয়ে গেলে এই মিষ্টির স্বাদ থাকবে না।”
২। রাজবাড়ীর চমচম

রাজবাড়ির চমচম হলো বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার উৎপন্ন এক ধরনের মিষ্টি। টাঙ্গাইলের চমচম যেমন বাংলাদেশে বিখ্যাত তেমনি রাজবাড়ী জেলার চমচম ও বাংলাদেশে খুব বেশি বিখ্যাত। এই চমচম স্বাদে অতুলনীয়।
রাহবাড়ীর চমচম প্রথম তৈরী করেন ভাদু সাহা নামে একজন মিষ্টি প্রস্তুতকারক। তিনি বাংলাদেশের মিষ্টি প্রস্তুতকারকদের মাঝে অন্যতম একজন ছিলেন।
এই চমচম সাধারণত হালকা রসালো হয়ে থাকে। এই চমচমের স্বাদ ও গন্ধ অন্য সব চমচমের থেকে আলাদা। রাজবাড়ির ক্ষীরের প্রলেপ দেওয়া চমচম অত্যন্ত সুস্বাদু। এই চমচম তৈরীর মূল উপকরণ হলো দুধ। এছাড়া রাজবাড়িতে ছানার চমচম ও বিখ্যাত।
৩। নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টি

নেত্রকোনা জেলার একটি বিখ্যাত মিষ্টি বালিশ মিষ্টি যা শুধু এই জেলাতেই নয় বাংলাদেশের সকল জায়গাতেই সুনাম অর্জন করেছে। এই মিষ্টি আকারে বালিশের মতো ওতো বড় নয় কিন্তু দেখতে অনেকটাই বালিশের মতো।
বালিশ মিষ্টির প্রথম রুপকার হিসাবে পরিচিত হন গয়ানাথ ঘোষ। তার স্বপ্ন ছিল এমন একটা মিষ্টি তৈরী করা যেটা স্মৃতির পাতায় অমর হয়ে থাকবে। তার এই স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায়।
বালিশ মিষ্টি তৈরী করা হয় দুধ, ছানা, চিনি ও ময়দা দিয়ে। এই মিষ্টি বিক্রি করা হয় পিস হিসাবে। বালিশ মিষ্টির তিনটি সাইজ আছে। সবচেয়ে বড় বালিশ মিষ্টির আকার ১৩-১৪ ইঞ্চি।
৪। মুক্তাগাছার মন্ডা

ময়মনসিংহ শহর থেকে ১৬ কিঃমিঃ দূরে মুক্তাগাছা। গোপাল পাল নামে এক ব্যক্তি স্বপ্নে এক সাধুর সাক্ষাত পান। তার থেকেই তিনি এই মন্ডার দেখা পান। তারপর তিনি এই মিষ্টি বানিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তার উত্তরাধিকারীরা এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখে।
চ্যাপ্টা দেখতে এই মন্ডা অনেকটাই সন্দেশের মতো। মুক্তাগাছায় গেলে এই মিষ্টির স্বাদ পাওয়া যায়।
এই মিষ্টির মূল উপাদান চিনি ও দুধ। এই মিষ্টি খুব নরম ও শুকনো। এটি সাদা কাগজে মোড়ানো থাকে। এইটুকু তথ্যই এই মিষ্টি খেয়ে বোঝা যায়। তাছাড়া এই মিষ্টি কিভাবে বানানো হয় তা কখনো পরিবারের বাইরে যায়নি। কেউ কখনো পরিবারের বাইরের কারো কাছে মিষ্টি তৈরীর প্রণালী বলে না।
৫। মেহেরপুরের সাবিত্রী ও রসকদম্ব

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী ছিল মেহেরপুর জেলা। মেহেরপুরের একটি মিষ্টি খুব বিখ্যাত। রসছাড়া মিষ্টি রসকদম্ব ও সাবিত্রী মিষ্টি মেহেরপুর জেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বর্তমানে শুধু বাংলাদেশেই নয় বিদেশেও এই মিষ্টির প্রচলন খুব বেশি। দুধ অর্থাৎ দুধের চাছি এই মিষ্টির প্রধান উপকরণ। নির্দিষ্ট সময় ধরে ইএ মিষ্টি নির্দিষ্ট তাপে জ্বাল করে বানানো হয়।
এই মিষ্টির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই মিষ্টি ফ্রিজে না রেখেই এক সপ্তাহ পর্যন্ত খাওয়া যায়।
৬। রাজশাহীর রসকদম্ব

রাজশাহী জেলার আম যেমন বিখ্যাত বিশ্বে দরবারে আমাদের দেশকে পৌছে দেয় তেমনি রসকদম মিষ্টি ও খুব বিখ্যাত। বাংলাদেশ ও ভারতের একটি বিখ্যাত মিষ্টি রসকদম্ব। রাজশাহী জেলার চাপাইনবাবগঞ্জে এই মিষ্টির খুব প্রচলন রয়েছে।
জনশ্রুতি অনুসারে হুসেন শাহের রাজত্বকালে গৌড়ে এসেছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভু। তিনি কেলি কদম্ব গাছের নিচে বসে রুপ সনাতনকে দীক্ষা দেন। সেই কেলি কদম্ব গাছের নাম থেকে রসকদম্ব মিষ্টির শুরু।
রসকদম্ব মিষ্টি ছানা, চিনি, পোস্ত ও ক্ষীর দ্বারা বানানো হয়। এই মিষ্টির উপরে কদমের মতো প্রলেপ দেওয়া হয়। বর্তমানে পোস্তের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই চিনির দানা ব্যবহার করেন। আবার কেউ কেউ ক্ষীরের গুড়াও ব্যবহার করেন।
৭। কুষ্টিয়ার চমচম

কুষ্টিয়া শহরে সুস্বাদু একধরনের চমচম পাওয়া যায়। এটি স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। প্রাচীন কাল থেকেই এই মিষ্টির জুড়ি মেলা ভার। এই মিষ্টি এখন দেশ ছেড়ে বিদেশেও পাওয়া যায়।
৮। কালোজাম

মিষ্টির কথা চিন্তা করলেই মোগল আমলের কালোজামের কথা মনে পড়ে যায়। সেই যুগে কালোজাম নামে একটি মিষ্টির উৎপত্তির কথা শুনতে পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়িয়ে তুর্কিতেও এই মিষ্টির সমাদর রয়েছে। চিনি, ছানা ও মাওয়া দিয়ে তৈরী করা হয় এই কালোজাম।
৯। অমৃতি

ভারত উপমহাদেশে অমৃতি মিষ্টির প্রচলন হয়ে বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশ দুই জায়গাতেই এই মিষ্টির খুব প্রচলন রয়েছে। লাল বা কমলা রঙয়ের হয়ে থাকে এই মিষ্টি। উপরটা খানিকটা শক্ত কিন্তু ভিতরটা রসে ভরা। দুধ বা ছানা ব্যবহার করা হয় না এই মিষ্টিতে। ডাল বেটে অমৃতি বানানো হয়।.
১০। জিলাপি

পশ্চিমা এশিয়া থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে জিলাপির আগমন ঘটে। ইহুদিরা অনেক আগে থেকেই জিলাপির সাথে পরিচিত। আরবি শব্দ জুলাবিয়া থেকে জিলাপি শব্দের উৎপত্তি। ভারতীয় উপমহাদেশে এই মিষ্টি প্রথম আনে মুসলিমরা। গরম জিলাপি খেতে খুব মজা।
এছাড়া বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি লিখা থেকে মিষ্টি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন।
আরো পড়ুনঃ
বুফেতে যেসব খাবার বর্জন করা উচিত
যে পাচটি খাবারে হার্ট অ্যাটাকের ঝুকি কমাবে
ভোজন রসিক বাঙ্গালি ও তার রসনা বিলাসের চিরাচরিত অভ্যাসের সাতকাহন
পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতার এবং বিভিন্ন জেলার লোভনীয় মিষ্টির কথা