বার্ধক্যে কি কি পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়া যেতে পারে
বার্ধক্যে কি ধরনের পুষ্টি প্রয়োজন?

প্রাকৃতিক কারণেই মানুষ বৃদ্ধ হয়। দেহের কোষে নিরন্তর জীবন প্রবাহ চলতে চলতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তার ফলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কতগুলো রোগ হওয়ার আশংকা বাড়তে থাকে। ত্রুটিপূর্ন খাদ্যাভ্যাসের দরুন যদি কারো কোন একটি পুষ্টি উপাদানের সামান্যতম অভাবও দীর্ঘদিন থেকেই ঘটতে থাকে, তবে তার প্রভাব বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেহে পরিস্ফুট হতে থাকে। বর্তমান শতাব্দীতে চিকিৎসা শাস্ত্র, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, ফলে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন দেশে ৬০ বৎসরের বেশী লোকের সংখ্যা কম নয়। এই বিপুল জনগোষ্ঠী সমাজের বোঝা না হয়ে যেন সুস্থ দেহে কর্মক্ষম থেকে দেশ ও সমাজে অবদান রাখতে পারে সেই চেষ্টা করা উচিত।
বার্ধ্যেকে খাদ্যের ভূমিকা এমন হওয়া উচিত যেন তা বিভিন্ন রকম বার্ধ্যকজনিত দীর্ঘমেয়াদী রোগ যেমন- ক্রনিক হৃদরোগ, ক্যান্সার, ধমনীর কঠিনত্ব, কিডনীর রোগ, ডায়াবেটিস, বাত ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা করে দেহকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখে। এজন্য অল্প বয়স থেকেই সুষম খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস করতে হয়। নাহলে বৃদ্ধ বয়সে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
খাদ্য উপাদানের চাহিদাঃ
ক্যালরিঃ বয়স বাড়ার সাথে সাথে কায়িক শ্রম সাধারণত কমে আসে, এজন্য ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে না দিলে ওজনাধিক্য হওয়ার আশংকা দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গেছে ক্ষীণকায় লোক বেশি দিন বাচে এবং সুস্থ হয়েই বাচে। সুতরাং সুস্থ ও কর্মক্ষম অবস্থায় দীর্ঘায়ু হতে হলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বয়বৃদ্ধির সাথে সাথে মৌলিক বিপাক হার মন্থর হয়ে আসে, চলাফেরা কাজকর্ম সবই কমে আসে, অথচ অনেকেরই খাদ্যাভ্যাস আগের মতোই থাকে। এ অবস্থায় সহজেই ওজন বেড়ে যেতে থাকে। বয়স ৬০ বছরের উপরে গেলে ওজন কিছুটা কম থাকাই স্বাভাবিক নিয়ম। কোন ব্যক্তির ওজন ৪০ বছরে যা ছিল,৭০ বছরেও যদি তাই থাকে তবে বুঝতে হবে পেশীর স্থানে মেদ জমেছে। সুতরাং ৫০ বছরের উপর বয়স হলে মোট খাদ্যের পরিমাণ বিশেষত স্নেহ পর্দাথের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে, যেন খাদ্যে প্রয়োজনাতিরিক্ত ক্যালরি না থাকে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এর মতে- ৫০- ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত এই তিন দশকে ক্যালরি কমানো উচিত প্রতি দশকের জন্য শতকরা ৭.৫ হারে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে যে এই বয়সের মহিলারা ১৫০০ কিলোক্যালরি যুক্ত খাদ্য এবং পুরুষেরা ২০০০ কিলোক্যালরি যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হন।

শর্করা ও স্নেহঃ যেহেতু এই দুইটি উপাদান খাদ্যে ক্যালরির পরিমাণ বাড়ায় কম ক্যালরির খাদ্য প্রস্তুতের সময় এ দুটোই কমিয়ে ফেলতে হবে। চিনি, গুড়, গ্লুকোজ ইত্যাদি সহজে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায় এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখা দেহের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। সেজন্য বৃদ্ধ বয়সে মিষ্টিজাতীয় খাদ্য পরিহার করা উচিত। দৈনিক বরাদ্দ শর্করা জাতীয় উপাদানের সবটুকুই শ্বেতসারজাতীয় খাদ্য থেকেই গ্রহণ করা ভালো। ভাত, আলু ও রুটি খাদ্যে শ্বেতসারের ভালো উৎস।
খাদ্যে স্নেহ পদার্থের পরিমাণ কমিয়ে আনা একান্তভাবেই দরকার। বিশেষ করে জমাট স্নেহ অর্থাৎ চর্বি বয়স্ক মানুষের রক্তে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে নানারকম হৃদরোগের সূচনা করে। এছাড়া বয়স বাড়লে যকৃত, প্যানক্রিয়াস ইত্যাদির কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় চর্বি পরিপাকে বিঘ্ন ঘটতে পারে। এজন্য এসময় সম্পৃক্ত চর্বি না খাওয়াই ভালো। উদ্ভিজ্জ তেল যেমন সয়াবিন, কার্ন ইত্যাদির তেল অস্পম্পৃক্ত স্নেহজ এসিডের ভালো উৎস। সুতরাং খাদ্যের বরাদ্দ স্নেহ, ঘি বা ডালডা থেকে না হয়ে উদ্ভিজ্জ স্নেহ থেকে হওয়াই বাঞ্চনীয়।
প্রোটিনঃ বৃদ্ধ বয়সে ক্যালরির চাহিদা কমে এলেও প্রোটিনের চাহিদার কোন তারতম্য ঘটেনা। আমাদের দৈনন্দিন প্রোটিনের চাহিদার অর্ধেক পূরণ হয় ভাত ও রুটি থেকে। বৃদ্ধ বয়সে ক্যালরির চাহিদা কমে গেলে স্বভাবতই ভাত ও রুটির পরিমাণ কমিয়ে ফেলতে হয় , তখন প্রোটিন খাদ্যের দিকে বিষেষভাবে লক্ষ্য না রাখলে খাদ্যে প্রোটিনের ঘাটতি হবার আশঙ্কা থাকে। নানাবিধ কারণে বৃদ্ধ ব্যক্তিদের খাদ্যে মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদির পরিমাণ কমে যায়, ফলে এসময় প্রোটিনের অভাবে অনেকেই ভুগতে থাকেন। সুতরাং প্রত্যহ সহজপাচ্য কমচর্বিযুক্ত মাছ ( বোয়াল, রুই বা চিতলের পেটি ব্যতীত ) ও কিছু দুধ খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে।
খনিজ লবণঃ বয়স বাড়তে থাকলে ক্যালসিয়াম ও লোহার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ক্যালসিয়ামের অভাবে অস্থির ভংগুরতা প্রায়ই বৃদ্ধ বয়সে দুরবস্থার কারণ হয়ে দাড়ায়। এসময় ক্যালসিয়ামের শোষণ ও বিপাক ক্রিয়ার বিঘ্ন ঘটার ফলে দেহে এর অভাব দেখা দেয়। যে সমস্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সূর্যের আলোয় কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত তাদের অস্টিওপোরেসিস নামক অস্থির রোগ হতে পারে। দুধ ক্যালসিয়ামের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট উৎস। দুধ যদি হজম করতে অসুবিধা হয় তবে ২\১ ফোটা লেবুর রস দিয়ে ঈষৎ উষ্ণ দুধ পান করলে হজম হবে। আমাদের দেশে চুন দিয়ে পান খাওয়ার যে অভ্যাস আছে তা গরীব জনসাধারণের জন্য একটি মঙ্গলজনক অভ্যাস। বৃদ্ধ বয়সে ক্যালসিয়ামের অভাব এই চুন ই পূরণ করতে পারে। লোহার অভাবে বৃদ্ধ বয়সে এনিমিয়া হওয়ার নজির দেশে বিদেশে সব স্থানেই রয়েছে। ডিমের কুসুম, কলিজা, ডাল, শাক সবজি লোহার অভাব দূর করতে পারে। সঙ্গতি থাকলে সপ্তাহে ২-৩ টি ডিম খাওয়া ভালো।
ভিটামিনঃ বৃদ্ধ বয়সের খাদ্যে ভিটামিন এ-র গুরুত্ব সর্বাধিক। চোখের বিভিন্ন রোগ ও রাতকানা রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভিটামিন এ-র দরকার খুব বেশী। এই বয়সের এনিমিয়া শুধু লোহার অভাব থেকেই হয় তাই নয়। খাদ্যে পর্যাপ্ত ভিটামিন- বি কমপ্লেস্ক ও ভিটামিন সি না থাকলেও এনিমিয়া হতে পারে। এই কারণে প্রচুর ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ও ভিটামিন সি গ্রহণ করলে বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।
পানিঃ এসময় প্রচুর পানি পান করা ভালো। এতে খাদ্যদ্রব্যের পরিপাকে সহায়তা হয়, কোষ্ঠ পরিষ্কার হয় ও কিডনীর কাজ ভালোভাবে চলতে থাকে।

জীবনের বিভিন্ন সময়ের মতো বার্ধক্যেও সুষম খাদ্য প্রস্তুত করতে মৌলিক খাদ্য গোষ্টির তালিকা অনুসরণ করা উচিত। এই সময়ে অনেকেরই অরুচি ও খাদ্য পরিপাকে অক্ষমতার দরুন খাদ্যের স্পৃহা কমে আসে। দাঁতও সবকয়টি থাকে না, থাকলেও এমন অবস্থায় থাকে যে শক্ত খাদ্য গ্রহণ করা যায় না। সেজন্য এসব দিকে খেয়াল রেখে এমন খাদ্য নির্বাচন করতে হবে যেন খাদ্য সহজপাচ্য ও নরম হয়। বয়স্ক ব্যক্তির খাদ্যে দুধের প্রয়োজনীয়তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ক্যালসিয়াম, প্রোটিন ও উচ্চমানের ভিটামিন থাকায় দুধ দেহের পুষ্টি জোগাতে যেমনি সক্ষম তেমনি সুপাচ্য ও তরল হওয়ায় দন্তহীন বৃদ্ধের জন্য আকর্ষণীয় ও অপরিহার্য হবে বিবেচিত।
শাকসবজি ও ফল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বিশেষভাবে সহায়তা করে প্রত্যহ প্রচুর পরিমাণে এইসব খাদ্যবস্তু খাওয়া দরকার।পাকা পেপে, আম, তরমুজ, কলা, বাঙ্গি ইত্যাদি ছোট ছোট টুকরা করলে খাওয়া সহজ হয়। আনারসের রস, আখের রস, পিয়ারা সিদ্ধ, কুলচুর ইত্যাদি সহজে খাওয়া সম্ভব বলে বৃদ্ধবয়সে এগুলির উপর নির্ভর করার দরকার হয়।
যেসব খাদ্য বিশেষ করে পরিহার করে চলতে হবে সেগুলি হচ্ছে পরোটা, লুচি, ডালপুড়ি, সিঙ্গারা, সমুচা, বিরিয়ানী, রোস্ট ইত্যাদি দুস্পাচ্য খাদ্য এবং রসগোল্লা, পানতুয়া,জিলাপি, অমৃতি, শনপাপড়ি ইত্যাদি মিষ্টান্ন। পায়েস, পুডিং ও পিঠায় তেমন চিনি থাকেনা, সুতরাং এগুলি মাঝে মাঝে গ্রহণ করা যেতে পারে-এতে খাদ্যে বৈচিত্র্য আসবে।
আরো পড়ুনঃ