
শিশুর জন্য মায়ের দুধ একটি উৎকৃষ্ট খাবার। শিশুকে জন্মের পর থেকেই মায়ের দুধ খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে মায়ের পর্যাপ্ত আন্তরিকতা থাকলেও শিশু সঠিকভাবে দুধ পান করতে পারে না।
যেহেতু মায়েরা নতুন দুধ খাওয়াতে শিখে এবং বাচ্চারাও খুব ছোট থাকে তাই ভালো মতো দুধ পাওয়া যায় না। মূলত প্রসবের পরে মায়ের বুকে দুধ আসতে আধা সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় শিশু দুধ না পেলে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এভাবে কান্নাকাটি করতে করতে একসময় শিশু আর দুধ মুখেই দিতে চায় না। শিশু দুধ খেতে না চাইলে অনেক বয়স্ক মানুষেরা নানা পরামর্শ দিতে থাকে। এ থেকে জন্ম নেয় মায়ের হীনম্মন্যতা।
লক্ষ্য করে দেখা গেছে যে সমস্ত মায়েদের মাঝে প্রায় পঁচিশ শতাংশের স্তন্যদান করতে তিন দিনের বেশি সময় লেগে যায়। এ থেকে এটা ভাবলে হবে না যে আপনি শিশুকে আর দুধ খাওয়াতেই পারবেন না।
শিশু জন্মের পর মায়ের যে দুধ উৎপন্ন হয় তা দেখতে দুধের মতো না আবার পরিমাণেও অল্প হয়। এটা শালদুধ। অনেকে মনে করেন এই দুধ শিশুকে খাওয়ানো উচিত নয়। শিশুর সমস্যা হতে পারে। কিন্তু তা নয়।
এই দুধ শিশুর জন্য খুবই উপকারী। তাই শিশু জন্মের পর থেকেই শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খেতে দিতে হবে।
আরো পড়ুনঃ শিশুদের ডায়রিয়া হলে কি করবেন
প্রসবের পরে বুকের দুধ কখন আসে?
প্রোল্যাকটিন নামক হরমোন মায়ের দেহকে দুধ উৎপাদন করতে সাহায্য করে। এই হরমোন গর্ভাবস্থার সমস্ত সময় মিলেই গড়ে উঠে।
অন্যদিকে, প্রোজেস্টেরন নামক হরমোন মায়ের দুধ উতপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। এই হরমোন প্রোল্যাকটিন হরমোনকে কাজ করতে বাধা দেয়।
মায়ের দুধ উৎপাদন শুরু হয় যখন বাচ্চা জন্ম হয়। কিন্তু বাচ্চা জন্মানোর আগেই মাঝে মাঝে গর্ভবতী মহিলারা অনুভব করেন তাদের স্তন থেকে খুব অল্প পরিমাণে দুধ বের হচ্ছে। এটি আসলে কোলেস্ট্রাম। এটি বাচ্চাদের বুকের দুধ প্রবেশের আগে পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে।
আরো পড়ুনঃ শিশুর যত্নে লক্ষ্যণীয় বিষয়
বুকের দুধ না থাকার কারণ

প্রতিটি নবজাতকের জন্যই মায়ের বুকের দুধ খুব উপকারী। মায়ের বুকের দুধের কোন বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু মাঝে মাঝে ম্যা ও বাচ্চার কিছু অভ্যন্তরীণ কারণে বাচ্চা ঠিকমতো দুধ পায় না।
তখন সে কান্নাকাটি শুরু করে। মাও মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বাচ্চাকে দুধ দিতে চায় না। মায়ের বুকে কম দুধ আসতে পারে বা দুধ আসতে কিছুদিন পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
তার পিছনে কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। এখন আমরা সেসব কারণগুলো সম্পর্কে জানবো।
১. চাপ
বর্তমানে আধুনিক জীবনযাত্রা, বন্ধুবান্ধব, পরিবার, আত্নীয়স্বজন প্রভৃতি মানুষের সাথে কম যোগাযোগ থাকে এবং এখন আমাদের প্রত্যেকের হাতেই খুব কম সময় থাকে। আবার বাচ্চা জন্মানোর সময় চিকিতসাগত যেসব চাপ থাকে তার কারণেও মায়ের মন খারাপ থাকতে পারে।
আবার মায়ের নিজের কোন স্ট্রেস থাকতে পারে। এসব স্ট্রেস মায়ের শরীরে বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে। মায়ের হতাশা, উদ্বেগ মায়ের দুধ উৎপাদনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
২. হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
আমাদের শরীরের থাইরয়েড গ্রন্থি হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েড গ্রন্থির কোন ধরনের কোন সমস্যা থাকলে এটি হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য মায়ের বুকের দুধ কম হতে পারে। ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন স্তনের বিকাশ ঘটায়। প্রোল্যাক্টিন হরমোন মায়ের দুধ উতপাদনে সাহায্য করে এবং অক্সিটোসিন হরমোন নালীর মধ্য দিয়ে দুধ প্রবাহিত করতে সাহায্য করে। তাই এসব হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য মায়ের বুকের দুধ কম হতে পারে।
৩. লাইফস্টাইল
গর্ভাবস্থায় মাকে নিজের লাইফস্টাইলের দিকে মনোযোগ দিতে হয়। এসময় ম্যা যদি একটি খারাপ লাইফস্টাইল লিড করে তাহলে মায়ের উপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। মাকে এসময় নিজের প্রতি অনেক যত্ন নিতে হয় ও মাকে নিজের প্রতি মনোযোগী থাকতে হয়।
এসময় যদি ম্যা একটি খারাপ জীবনধারা গড়ে তুলে যেমন- ধূমপান, অ্যালকোহল পান, অনুপযুক্ত খাবার ও উচ্চ ক্যাফিনে আগ্রহী হয়ে পড়ে তাহলে এগুলো মায়ের দুধ উতপাদনে বাধার সৃষ্টি করে।
৪. জন্ম নিয়ন্ত্রণ
অনেকসময় দেখা যায় মায়েরা না বুঝেই গর্ভবতী হয়ে পড়ে। তখন তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণের নানা ওষুধ খায়। এতে হরমোনের কাজ বাধা প্রাপ্ত হয়। এসব কারণে মায়েদের দেহে প্রভাব পড়তে পারে। তাছাড়া অনেক মহিলারা শুরু থেকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ ওষুধ খায় ফলে তাদের দেহে দুধ উৎপাদন হয় না।
৫. কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ ও ভেষজ গ্রহণ করা
জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওষুধের মতোই অন্যান্য কিছু ওষুধ রয়েছে যা বুকের দুধ উতপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। আবার কিছু ভেষজ উপাদান আছে বুকের দুধ উতপাদনে বাধা প্রদান করে। কেউ কেউ নিয়মিত কোণ ওষুধ নিতে থাকে যেগুলো মায়ের বুকের দুধ আসতে বাধা প্রদান করে।
আবার কিছু ভেষজ যেমন- পার্সলে, অরিগানো, পেপারমিন্ট দীর্ঘদিন গ্রহণ করতে থাকলে বুকের দুধ উতপাদনে বাধা সৃষ্টি হয়। তাই আমাদের উপযুক্ত ডায়েট ও ভালো চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্ষ অনুযায়ী ওষুধ ও ভেষজ গ্রহণ করতে হবে।
৬. পরিবেশ এবং আশেপাশের জায়গা
আমাদের আশেপাশে সবসময় বায়ি দূষণ, পানি দূষণ ও পরিবেশ দূষণ দেখা যায়। এসব দূষণের ফলে বুকের দুধ উৎপাদনে সমস্যা হতে পারে। বুকের দুধ খায় যেসব শিশু তাদেরকে কিছু সময়ের জন্য ভিড় ও দূষণ থেকে বিরত রাখতে হবে। খাদ্য ও পানি যেন পরিষ্কার হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৭. কঠিন প্রসব
আমরা সবসময় যেমনটা ভাবি সেরকম হয় না। এটি গর্ভাবস্থার সাথেও মিলে। বাচ্চা প্রসবের সময় বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ডাক্তার ও নার্সের ভুল, অধিক রক্তক্ষরণ, বাচ্চার দেহে আঘাত লাগা ইত্যাদি প্রসবের সময় দেখা দিতে পারে। এসব প্রসবের সময় সমস্যার ফলে মায়ের বুকের দুধের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
৮. স্টোরেজ আকার
কোন কোন মহিলার স্তনে যে পরিমাণ দুধ উতপাদিত হয় ও সঞ্চিত থাকে তা তার স্তনের আকারের তুলনার সাথে সম্পর্কিত। কোন মহিলার স্তন বড় কিন্তু দুধের ধারণ ক্ষমতা কম থাকতে পারে।
আবার কিছু মহিলার এর বিপরীত ও হতে পারে। কখনো কখনো স্তনের দুইপাশ সমান দুধ ধারণ করতে পারে না। ফলে এক্ষেত্রে শিশু বেশি দুধ পায় না। যাদের দুধ উতপাদন ও সঞ্চয় করার ক্ষমতা বেশি তারা শিশুকে পর্যাপ্ত দুধ পান করাতে পারে।
৯. দুধের অপর্যাপ্ত বের করা
শিশুকে যত বেশি দুধ পান করানো যাবে মায়ের দেহ তত বেশি দুধ উৎপাদন করতে পারবে। যদি শিশু বেশি দুধ পান করতে না পারে তাহলে অবশিষ্ট দুধ স্তনকে আর বেশি দুধ উতপাদন করতে দেয় না। স্তনে জমে থাকা দুধ আগে শেষ করতে হয় তারপর আবার দুধ উৎপন্ন হয়।
আরো পড়ুনঃ গর্ভবতী মায়ের যত্ন
প্রসবের পর বুকের দুধ যদি একেবারেই না আসে তাহলে মন খারাপ করার কোন দরকার নেই। মন খারাপ করলে স্ট্রেস হরমোনগুলো আরো বাড়তে শুরু করে ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
কিছু সময় পর পর হাত দিয়ে বুকের দুধ বের করে দিতে হবে। স্তন্যদানের সূচনা না পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শিশুকে বাজার থেকে কেনা দুধ খাওয়াতে হবে।
স্তন্যপান করানো দ্রুত শুরু করার টিপস
১. বুকের দুধে হাতের ব্যবহার
মায়ের বুকে যদি দুধ না আসে বা শিশু যদি দুধ না পায় তাহলে হ্যান্ড এক্সপ্রেস বা হাত ব্যবহার করতে হবে। এটি করলে মায়ের স্তনে দ্রুতই দুধ চলে আসে।
২. আপনার স্তন ম্যাসাজ করুন
মায়ের স্তন হালকাভাবে সার্কুলার মোশনে ম্যাসাজ করতে হবে। এটি স্তনে তাড়াতাড়ি দুধ আনতে সাহায্য করে।
৩. ত্বকের সাথে ত্বকের যোগাযোগ বাড়ান
শিশুকে মায়ের ত্বকের সাথে জড়িয়ে রাখতে হবে। শিশুকে মায়ের কাছাকাছি রাখতে হবে। মায়ের ত্বকের সাথে আলতো করে শিশুর ত্বক ঘষে দিতে হবে। তাহলে মায়ের বুকে দুধ আসতে পারে।
৪. কোন ওষুধ গ্রহণ এড়িয়ে চলুন
গর্ভাবস্থায় মাকে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোন ধরনের ওষুধ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পরামর্শ ব্যতীত কোন ওষুধ গ্রহণ করতে সেগুলো মায়ের দুধ উতপাদনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আবার বাচ্চার মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা প্রদান করতে পারে।
৫. আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন
প্রথমেই ডাক্তারকে বিরক্ত করা উচিত নয়। কিছু সময় অপেক্ষাকরতে হবে। যখন স্বাভাবিকভাবেই দুধ আসবে তখন শিশুকে দুধ খাওয়াতে শুরু করতে হবে। যদি স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়া না ঘটে তাহলে দুধ না পাওয়ার কারণ খুজে বের করতে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
মায়ের সাথে সন্তানের ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে স্বাভাবিকভাবে শিশুকে দুধ পান করানোর উপর আর কোন কথা নেই। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য শিশুকে দুধ পান করাতে হবে। মায়ের যদি একেবারেই কোন দুধ না আসে তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে হবে।
আরো পড়ুনঃ শিশুদের করোনা থেকে মুক্ত রাখতে কি করবেন
3 Comments